
মোঃ জমির আলী হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধিঃ
হবিগঞ্জ জেলায় বিচারকের আসন ছেড়ে তিনি দৌড়াচ্ছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। একবার পুলিশ প্রশাসনের সাথে বৈঠক করছেন তো অন্যবার ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বারদের নিয়ে বৈঠক করছেন। পরক্ষনেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিশ বিচারে। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় । হবিগঞ্জ কারাগারের বেশির ভাগ বন্দীর আপনজন সম্পা জাহান। তিনি হবিগঞ্জের লিগ্যাল এইড অফিসার একই সাথে সিনিয়র সহকারী জজ। তার জন্য অপেক্ষা করে শতশত বন্দী। কারাগারের ভেতরে তার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারে, সমাধানের পথ খোজে পায় তারা। কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে নয় সরাসরি বিচারকের সাথে কথা বলে একটা সমাধান বের করে নিয়ে আসা বিচার প্রার্থীদের সংখ্যা অনেক। কারাবন্দীদের অনেকের বিস্তর অভিযোগ কোনো কোনো আইনজীবীর বিরুদ্ধে। জেল সুপার বা জেলারের বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। এর কোনোটি সত্য কোনোটি মিথ্যা। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আইনজীবী কেন জামিন করিয়ে দেন না, কেন তাদের লিগ্যাল এইডের আবেদন সঠিকভাবে কারাগারে লিপিবদ্ধ থাকে না। কারাবন্দীদের অভিযোগ শুনাতে গত ২ নভেম্বর লিগ্যাল এইডের প্যানেলভূক্ত কয়েকজন আইনজীবীকে কারাভ্যন্তরে নিয়ে যান সম্পা জাহান। বৈঠক করেন কারাবন্দীদের সাথে। স্ত্রী হত্যার দায়ে হাজতে থাকা রঙ্গু মিয়ার অভিযোগ তার মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এডভোকেট এম এ মজিদ কোনো প্রতিকার নিচ্ছেন না। কারাগারের ভেতরে বৈঠকে থাকা এডভোকেট এম এ মজিদ তথ্য উপাত্ত ঘেটে দেখেন তার কাছে রঙ্গু মিয়ার মামলাটি পরিচালনা করার জন্য লিগ্যাল এইড অফিস থেকে কোনো অফিস আদেশ পৌছেনি। রঙ্গু মিয়ার কেইস কার্ডে থাকা তথ্যের সাথে বাস্তবতার মিল পাওয়া যায়নি। আরেক বন্দী অভিযোগ করেন- তার মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে লিগ্যাল এইডের একজন আইনজীবী তার কাছে টাকা দাবী করে থাকেন। বিচারক সম্পা জাহান ওই আইনজীবীকে লিগ্যাল এইড থেকে বাদ দেয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। স্প্রে পার্টির সদস্য মৌলভীবাজার জেলার বাসিন্দা এক কারাবন্দী অভিযোগ করেন- তার জামিন দিচ্ছেন না আদালত। লিগ্যাল এইড অফিসার বলেন- আপনারা তো মানুষকে শান্তিতে ঘুমুতে পর্যন্ত দিচ্ছিলেন না।
স্প্রে পার্টির স্রোত চুনারুঘাট থেকে শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে হবিগঞ্জ শহরে প্রবেশের পথেই কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করতে আগ্রহীদের অনেকেরই ধারনা লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করলে বিচারকের সুদৃষ্টি পড়ে। বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। অন্য দশজনের মতোই লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মামলা পরিচালনাকারীরা সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন।
শুধু অর্থের অভাবে যাতে কেউ আইনের সুযোগ লাভ থেকে বঞ্চিত না হয় সে জন্যই লিগ্যাল এইড- জানালেন সম্পা জাহান। অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে লিগ্যাল এইড অফিসে। তন্মধ্যে লিগ্যাল এইড অফিসের গাড়ি না থাকা ও স্টাফ স্বল্পতা অন্যতম। ২০২১ সনের ১৬ মার্চ সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদায় লিগ্যাল এইড অফিসার হিসাবে হবিগঞ্জ জেলায় যোগদান করেন সম্পা জাহান। লিগ্যাল এইড অফিসকে সাজান তিনি নিজের মতো করে। সার্বক্ষনিক কর্মব্যস্ত থাকেন ওই অফিসের কর্মচারীরা। সম্পা জাহান লিগ্যাল এইড অফিসার হিসাবে যোগদানের পর তার দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ৮২২ টি। তন্মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৬১টি অভিযোগের। “মামলায় একজন হারে একজন জিতে। লিগ্যাল এইড অফিসে আসলে সবাই জিতে, কেউ হারে না” বলছিলেন সম্পা জাহান। হবিগঞ্জের ৯টি থানায় সচেতনতা মূলক বৈঠক করেছেন তিনি। এই প্রথম খোলামেলা আলোচনার আয়োজন করে লিগ্যাল এইড অফিস। হত্যা, ডাকাতি, নারী ধর্ষন, রাষ্ট্রদ্রোহীসহ এ শ্রেণীর গুরুতর রাষ্ট্রবিরোধী মামলা ব্যতিত সকল শ্রেণীর মামলার বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি হয় লিগ্যাল এইড অফিসে। এমনও দেখা গেছে দুই পক্ষের মধ্যে ফৌজদারী, দেওয়ানী, পারিবারিক মিলিয়ে এক ডজনের বেশি মামলা চলমান। লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে উভয় পক্ষের বিরোধ নিষ্পত্তি করে দেয়া হয়েছে। ৫ নভেম্বর ২০২৩ ইং সকাল অনুমান ১১ ঘটিকা, লিগ্যাল এইড অফিসে গিয়ে দেখা যায়- বিচারক সম্পা জাহান কথা বলছেন জেলা সুপারের সাথে। জানতে চান যারা আইনের আশ্রয়লাভ থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছে, অর্থের অভাবে কোনো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারছেন না, হত্যাসহ গুরুতর অভিযোগের কারণে হবিগঞ্জের আদালতেও তাদের জামিন হওয়ার সম্ভাবনা কম, তাদেরকে কিভাবে আইনী সুযোগ দেয়া যায়। জেল সুপারকে এ ধরনের কারাবন্দীদের একটি তালিকা তৈরী করার পরামর্শ দেন তিনি। পরে সেগুলো পাঠিয়ে দেয়া হবে হাইকোর্টের লিগ্যাল এইড অফিসে। হাইকোর্টে বিনা পয়সায় কারাবন্দীরা আইনের প্রতিকার পেতে পারেন। কারাগার পরিদর্শনে গেলে বন্দীদের দুর্দশা দেখে মনে হয় সবাইকে ছেড়ে দেই, আবার অপরাধীদের নৃশংস অপরাধ দেখলে মনে হয়- সবাইকে কারাগারে পাঠিয়ে দেই। এই দুয়ের মধ্যেই একজন বিচারককে তার বিচারিক ও পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করতে হয়- বলছিলেন সিনিয়র সহকারী জজ সম্পা জাহান। ২০২১ সালের ১৬ মার্চ থেকে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ১ কোটি ১০ লাখ ৮৮ হাজার ৬৮৯ টাকা আদায় করে ভূক্তভোগীদের হাতে পৌছে দেয়া হয়েছে। এটা কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। যদি এসব টাকা আদায়ে নিয়মিত কোর্টগুলোতে মামলা দায়ের হতো তাহলে মামলার সংখ্যা অনেকগুন বেড়ে যেত। মামলার জট কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিকল্প কিছু নেই- জানালেন তিনি। মামলা দায়ের না করিয়ে শুধুই কি বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করে লিগ্যাল এইড? যারা লিগ্যাল এইডে আবেদন নিয়ে আসে তাদেরকে প্রথমে পরামর্শ দেয়া হয়। এর সংখ্যা ১৫৯৮টি। তাছাড়া লিগ্যাল এইডের অর্থায়নে ৬৩৪টি মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে। বিশ্বে এমন নজির খুব কম-যেখানে অপরাধ করবেন আপনি, আর মামলা পরিচালনার খরচ বহন করবে সরকার। এরই নাম লিগ্যাল এইড। একজন বিচারককে সাধারণ মানুষের খুব কাছে নিয়ে যায় লিগ্যাল এইড। এই সুযোগ একজন বিচারকের জীবনে একবারই আসতে পারে-জানালেন লিগ্যাল এইড অফিসার সম্পা জাহান। নায়ক সাকিব খানের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জে দায়েরকৃত একটি মামলা পরিচালনার সময় স্থানীয় ও জাতীয় মিডিয়ায় এমনকি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রায়ই সংবাদের অংশ হতেন সম্পা